যেখানে ই-মেইল করে মুহূর্তে পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে তথ্য পৌঁছানো সম্ভব তখন কে চিঠি লিখে ডাকে ফেলে অপেক্ষা করতে চায়? একটা কম্পিউটারের হার্ডডিস্কের মধ্যে যখন তথ্য ভাণ্ডার সংরক্ষণ করা যায়, মুহূর্তে যে কোনো তথ্য বের করা যায়- তখন কে কাগজ আর ফাইলের স্তুপ অফিসে সংরক্ষণ করে তা ঘাটাঘাটি করতে পছন্দ করে? ইন্টারনেট ব্যবস্থায় ওয়েবসাইটে যেয়ে যখন প্রতিষ্ঠানগুলোর সর্বশেষ তথ্য মুহূর্তে জেনে নেয়া যায়, সিদ্ধান্ত নেয়া যায়- তখন কে নিজেকে ঐ প্রযুক্তি থেকে দূরে রাখবে? প্রযুক্তির সুবাদেই যেখানে সকল তথ্য পাওয়া যায়, দেখা যায়, লেনদেন করা যায় তখন যে কোনো সচেতন মানুষ তার ব্যবহার করবে এটাই স্বাভাবিক । দূরে বসে যখন অডিও কনফারেন্স ও ভিডিও কনফারেন্স করা যায় তখন ব্যস্ত মানুষগুলোর সময়, শ্রম ও অর্থ ব্যয় করে সামনা সামনি বসে সভা করার তেমন প্রয়োজন থাকে না । তাই ব্যবসায়ের এমন কোনো দিক নেই যেখানে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার হচ্ছে না । নিম্নে ক্ষেত্রগুলো সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো:
১. কল-কারখানায় ব্যবহার (Use in factory) : কল-কারখানায় বৃহদায়তন উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার ব্যাপকতা লাভ করেছে। মজুদ ব্যবস্থাপনা, পণ্যমান নিয়ন্ত্রণ, উপকরণের যথাযথ ব্যবহার, অপচয় হ্রাস, শ্রমিক-কর্মীদের তথ্য সংরক্ষণ, হাজিরা নিয়ন্ত্রণ, বেতন-ভাতা প্রদানসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এরূপ প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার হচ্ছে। উৎপাদিত পণ্য বিক্রয়, বিক্রেতা, প্রতিনিধি, ডিলার ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ, তথ্য প্রদান, লেনদেন ইত্যাদির ক্ষেত্রেও এরূপ প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার লক্ষণীয় ।
২. বিক্রয়ধর্মী প্রতিষ্ঠানে ব্যবহার (Use in trading organization) : বিক্রয়ধর্মী প্রতিষ্ঠানের পণ্য সংগ্রহ ও বিক্রয়ে এরূপ প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার লক্ষণীয়। এরূপ প্রতিষ্ঠানের পণ্যের ক্যাটালগ, মূল্য তালিকা, শর্তাদিও ওয়েবসাইট তথা ভার্চুয়্যাল স্টোর (এমন সদৃশ স্টোর যা সপ্তাহের সাত দিন চব্বিশ ঘণ্টা খোলা থাকে) এ দেয়া পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে বা নিকটস্থ এজেন্টের নিকট থেকে সংগ্রহ করতে বলা হচ্ছে। মূল্য হ্রাস বা কোনো অফার ওয়েবসাইটে বা ওয়েবপেজে দেয়া হচ্ছে। ডিপার্টমেন্ট স্টোরে কোনো পণ্যের মূল্য কত তা দ্রুত নির্ধারণ করে। মূল্য পরিশোধেও এ প্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে । মজুদ নিয়ন্ত্রণ, হিসাব রক্ষণাবেক্ষণসহ বিভিন্ন কাজে এরূপ প্রতিষ্ঠান এ ধরনের প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল ।
৩. ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ব্যবহার (Use in bank & other financial institutions) : ব্যাংকে ICT এর ব্যবহার এতটাই দৃশ্যমান যে আজকের ব্যাংক ব্যবস্থা কার্যত এর ওপর দাঁড়িয়ে আছে। তথ্য সংরক্ষণ, ব্যবহার ও লেনদেনের সকল পর্যায়েই এ প্রযুক্তি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে সহায়তা করছে । সঠিক ও নির্ভুল লেনদেনে এবং গ্রাহকদের দ্রুত ও উন্নত সেবা দিতে এ প্রযুক্তি অত্যন্ত কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। অনলাইন ব্যাংকিং, ইলেকট্রনিক ফাও ট্রান্সফার, হোম ব্যাংকিং, মোবাইল ব্যাংকিং, ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড-এ ভাবে নানান সেবা ব্যাংক ব্যবস্থাকে অত্যন্ত জনপ্রিয় করেছে।
৪. আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে ব্যবহার (Use in import and export business) : আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে তথ্যাদি অনুসন্ধান, ফরমায়েশ প্রদান, দলিল-পত্রাদি হস্তান্তর, শুল্ক সংক্রান্ত আনুষ্ঠানিকতা পালন, মূল্য পরিশোধসহ সকল ক্ষেত্রেই ICT -এর ব্যবহার ব্যাপকভাবে লক্ষণীয়। ইলেক্ট্রনিক ক্যাটালগ, ই-মেইল, ভয়েস মেইল, ইন্টারনেট সেবা, ফ্যাক্স ইত্যাদি ICT সেবার মাধ্যমে এর সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীগণ খুবই স্বল্প সময়ে একদেশ থেকে অন্যদেশে পণ্য সরবরাহ করতে পারায় ও লেনদেন সম্পন্ন হওয়ায় বৈদেশিক বাণিজ্য ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে ।
৫. পর্যটন শিল্পে ব্যবহার (Use in tourism industry) : পর্যটন শিল্পেও ICT এর ব্যাপক ব্যবহার লক্ষণীয়। পর্যটকদের আগ্রহী করতে বিভিন্ন তথ্য ওয়েবসাইটগুলোতে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। বিভিন্ন আকর্ষণীয় অফার প্রদর্শিত হচ্ছে। ই-টিকেটিং এর সুবাদে বিমান, রেল, বাসসহ সকল যানবহনের টিকেট সহজেই কাটা হচ্ছে। হোটেল রিজার্ভেশনসহ সব কাজ এ প্রযুক্তির মাধ্যমে দ্রুত আগাম সেরে নেয়া সম্ভব হচ্ছে। পর্যটন স্থানগুলোর অধিক নিরাপত্তা বিধান এবং পর্যটকদের অধিক সেবা প্রদানও এর ফলে সম্ভব হচ্ছে। ফলে পর্যটন শিল্প বিগত দশকগুলোতে ব্যাপক প্রবৃদ্ধি অর্জনে সমর্থ হয়েছে।
৬. পরিবহণ শিল্পে ব্যবহার (Use in transport industry) : আকাশ, জল ও স্থলপথে দ্রুত ও নিরাপদে যাত্রী, ও পণ্য পরিবহণে ICT এর ব্যবহার অভাবনীয় । যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণ, ট্রাফিক কন্ট্রোলিং, টিকেট বুকিং, সিডিউল নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে এরূপ প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার হচ্ছে। বিমান পরিচালনায় ফ্লাইং, ল্যান্ডিং, বোর্ডিং কার্ড প্রদান, ইমিগ্রেশন, ফ্লাইট কন্ট্রোল, টিকেট বিক্রয় সবকিছুই এর মাধ্যমে সম্পন্ন হচ্ছে। রেল পরিবহণ ব্যবস্থাও এখন এরূপ প্রযুক্তির আওতাধীন। স্টেশনে থাকা, স্টেশন ত্যাগ, সিগন্যালিং সিস্টেমসহ কন্ট্রোলিং ব্যবস্থা এখন প্রযুক্তিনির্ভর । জলযানের ক্ষেত্রেও আবহাওয়া সংকেত, অবস্থান নির্ণয়সহ সকল কাজেই ICT সহযোগিতা করছে ।
৭. দুর্ঘটনা হ্রাসে সহায়তা (Help in reducing accident) : মানবীয় ভুল দুর্ঘটনার একটা বড় কারণ । চালক যখন ঘুমায় ও ভুল করে তখন দুর্ঘটনা ঘটে। ব্যাংক কর্মী যখন অসতর্ক হয় বা ইচ্ছাকৃত কোনো অপরাধ করে তখন দুর্ঘটনার কারণ সৃষ্টি হয়। কিন্তু প্রযুক্তি ঘুমায় না, ক্লান্তিহীনভাবে কাজ করতে পারে। অপরাধ প্রবণতা থেকে মুক্ত। উন্নত বিশ্বে এরূপ প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার পরিবহন সেক্টরে দুর্ঘটনার মাত্রা ব্যাপকভাবে কমিয়ে আনতে সাহায্য করেছে । সাইবার ক্রাইমের মত কিছু ঘটনা ঘটলেও ব্যাংকসহ সর্বত্রই আর্থিক লেনদেন এরূপ প্রযুক্তির সুবাদে অনেক নির্ভুল ও নিরাপদ হয়েছে ।
৭. শেয়ার, বিল ও বন্ড বাজারে ব্যবহার (Use in share, bill & bond market): শেয়ার, বিল ও বন্ড বাজারে এর সংশ্লিষ্ট ক্রয়-বিক্রয়ে ICT এর ব্যাপক ব্যবহার এ ব্যবসায়কে দারুণভাবে সমৃদ্ধ করেছে । নিউইয়র্ক, লণ্ডন, টোকিও ইত্যাদি বড় বড় শেয়ার ও বন্ড বাজার থেকে বাংলাদেশের যে কোনো ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান নির্ধারিত নিয়মে শেয়ার ও বন্ড ক্রয়-বিক্রয় করতে পারছে এরূপ প্রযুক্তির কারণেই । মোবাইলেই এ তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে মূল্য পরিশোধসহ সবকিছুই এরূপ প্রযুক্তি করে দিচ্ছে। এজেন্ট বা ব্রোকাররা এরূপ প্রযুক্তি ব্যবহার করে গ্রাহকদের এ সংক্রান্ত সকল লেনদেন সম্পাদন ও তথ্য সংরক্ষণের কাজ নির্ভুলভাবে দ্রুত করতে পারছে।
উপরোক্ত শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ছাড়াও সেবা বিক্রয়ধর্মী সকল ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান; যেমন- স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষাসেবা, বিনোদন সেবা, হোটেল, রেস্টুরেন্টসহ সর্বত্রই ICT এর ব্যাপক প্রয়োগ সামগ্রিক ব্যবসায় প্ররিস্থিতিকেই উন্নত, সম্প্রসারিত ও সমৃদ্ধ করেছে। যার সহযোগিতা ব্যতিরেকে ব্যবসায় পরিচালনার চিন্তায় কার্যত এখন অসম্ভব ।